ঢাকা, ১২ জুলাই ২০২০: জুন মাসে শিশু নির্যাতনের হার গত এপ্রিল ও মে মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বাল্যবিয়ের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু জুনেই ৪৬২ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গিয়েছে ২০৭ টি। বাল্যবিয়ের সংখ্যা মে মাসে ছিল ১৭০ টি এবং বন্ধ করা হয়েছিল ২৩৩ টি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০১৮-৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ সংক্রান্ত ন্যাশনাল একশন প্ল্যান বাস্তবায়নে এবং করোনার কারণে কন্যাশিশু ও কিশোরী মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে চলতি অর্থবছরে কোন নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়নি। যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এবং জোর করে বিয়ে বন্ধ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
শুধু বাল্যবিয়ে নয়, এই সময়কালের মধ্যে মোট ২৮৯৬ জন শিশু বিভিন্নধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মে মাসে নির্যাতনের এই সংখ্যা ছিল ২১৭১ জন। ৪৮ শতাংশ শিশু অর্থাৎ ১৩৭৬ টি শিশু নতুনভাবে নির্যাতিত হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে শতকরা ৬১ ভাগ শিশু।
দেশের ৫৩ টি জেলায় মোট ১২,৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৩৩২ জন নারী ও শিশু এর আগে কখনোই সহিংসতার শিকার হননি। মে মাসে নির্যাতিতের এই সংখ্যা ছিল ১৩,৪৯৪ জন। নারী ও শিশুর উপর মোট নির্যাতনের হার মে মাসের তুলনায় কমলেও, শিশু নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনাকালে নারী ও শিশুরা কেমন আছে তা জানার জন্য মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এপ্রিল থেকে প্রতিমাসে ধারাবাহিকভাবে টেলিফোনের মাধ্যমে তাদের কর্মএলাকায় তথ্য সংগ্রহ করছে। জুনে ৫৩ টি জেলার মোট ৫৭,৭০৪ নারী ও শিশুর সাথে কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে ১২,৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারীর সংখ্যা ৯৮৪৪ জন আর শিশুর সংখ্যা ২৮৯৬ জন। শিশুদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ১৬৭৭ জন অর্থাৎ শতকরা ৫৮ ভাগ, আর ছেলেদের সংখ্যা ১২১৯ জন অর্থাৎ শতকরা ৪২ ভাগ।
শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি সংখ্যক শিশু এই জুনেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বাড়ার অন্যতম কারণ হলো স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ করোনা বিষয়ক ত্রাণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তেমনভাবে নজর দিতে পারছেন না। এছাড়া করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অভাব, পাড়া-প্রতিবেশির প্রভাবে অভিভাবকরা আইন লঙ্ঘন করে কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন খুব গোপনে। এমজেএফ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
বাংলাদেশে শতকরা ৫৯ টি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তাদের ১৮ বছরের জন্মদিন হওয়ার আগেই। আর শতকরা ২২ জনের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে (তথ্যসূত্র ইউনিসেফ)। বাল্যবিয়ে ঘটার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ দেশ।
অবশ্য বাল্যবিয়ের চেয়েও অনেক বেশি শিশু অর্থাৎ ১৭৬৪ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯২ টি শিশু। ধর্ষণ করা হয়েছে ৯ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৯ টি শিশুকে যাদের মধ্যে ৮৬ জন মেয়ে। হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, অপহৃত হয়েছে ১০ জন, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে আরো ১২ জন।
মোট আক্রান্ত নারীদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১৯৫৬ জন বা ২০ শতাংশ। প্রতিবারের মত এবারও নারীদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগ নারী অর্থাৎ ৯৬৯৩ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। এই পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৬২২ জন, অর্থনৈতিক নির্যাতন ৩০০৯ জন, শারীরিক ১৮৩৯ এবং যৌন নির্যাতন ২২৩ জন, যৌন হয়রানি ৯৭, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩৫ জনকে, হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে এবং ত্রাণ আনতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫ জন।
সহিংসতার শিকার শিশু ও নারীদের এমজেএফ তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কাউন্সিলিং, ফলোআপ, সেবা প্রদানকারী সংস্থা, স্থানীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ সহয়তা, চিকিৎসা ও আইনগত সহায়তা প্রদান করেছে।
আজ এমজেএফ এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই তথ্য তুলে ধরে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপণ করেন এমজেএফ এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। এমজেএফ ডিএফআইডির এক্সক্লুডেড পিপলস রাইটস (ইপিআর), কানাডীয় সরকারের উম্যান ভয়েস এন্ড লিডারশীপ বাংলাদেশ (ডাব্লিউভিএলবি) এবং সুইডিশ সিডার স্ট্রেনদেনিং সিভিল সোসাইটি এন্ড পাবলিক ইন্সটিটিউশন টু এড্রেস কমবেটিং জেন্ডার ভায়োলেন্স এন্ড বিল্ড কমিউনিটি রেজিলেন্স টু ক্লাইমেট চেঞ্জ এই প্রকল্পের ১০৬টি সহযোগী সংগঠনকে সাথে নিয়ে এই জরিপ পরিচালনা করেছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনটি বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালকরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
এমজেএফ এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম মনে করেন, সরকারের উচিৎ স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিশেষ সার্কুলার দিয়ে জরুরিভিত্তিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে বন্ধ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। তিনি বলেন,”স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটিকে কার্যকর করে তুলতে হবে।”
শিশুরা তাদের অতি কাছের মানুষ অর্থাৎ বাবা-মা এবং নারীরা তাদের স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরির দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাধারণ ছুটি শেষ হয়ে গেছে এবং নারীরা কাজে ফিরতে শুরু করেছেন, তাই নারীর প্রতি সহিংসতার হার পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমলেও, শিশুরা যেহেতু এখনো গৃহবন্দী, তাই তাদের উপর নির্যাতনের হার বেড়েছে।
টেলিফোনের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের কাছ থেকে পারিবারিক সহিংসতার তথ্য বের করে আনা ছিল বরাবরের মতোই কঠিন। কারণ নারী ও শিশুরা নিজেদের সম্পর্কে বাইরের লোকের সাথে কথা বলতেই অনাগ্রহী ছিল। এছাড়া তার পাশে অবস্থান করছে পরিবারের অন্য সদস্যরা। নারী যে বাইরের মানুষের সাথে মোবাইলে ফোনে কথা বলছে এই কারণেও তাকে নির্যাতন করা হতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল।
যেহেতু নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা চলছেই তাই অন্যান্য সহায়তার পাশাপাশি এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। দ্রুত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করার জন্য সরকারের প্রতি সংবাদ সম্মেলনে আহ্বান জানানো হয় এর মধ্যে রয়েছে- যে হেল্প লাইনগুলো নারীদের সহিংসতা বন্ধে সহায়তা করে থাকে সেগুলো আরও কার্যকর করে তোলা এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।
সমাপ্ত//
বার্তা-প্রেরক:
শাহানা হুদা রঞ্জনা
সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন
০১৭১১৮৪৬৪৮০
ইমেইল: ranjana@manusher.org
TV news coverage
Newspaper coverage
Leave a Reply