ঢাকা, ২৯ জুলাই ২০২০ : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ করোনাকালে দেয় সরকারের প্রণোদনা সহায়তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছেন। আর তিন পার্বত্য জেলাসহ সমতল আদিবাসীদের মাত্র ২৫ শতাংশ পরিবার এই সহায়তা পেয়েছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফের) সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের প্রকল্প এলাকা থেকে এই তথ্য দিয়েছেন।
মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সহযোগী এনজিওদের তথ্য অনুযায়ী ২১,৮২৬ দলিত ও হরিজন, ২৯,৬৩১ প্রতিবন্ধী, ৪৯,২৩৯ জেলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়কালে সরকারি কোন সহায়তাই পান নাই। অন্যদিকে তিন পার্বত্য জেলা ও সমতল আদিবাসীদের মাত্র ৪১০০ টি উপকারভোগী পরিবার সরকারি সুবিধা পেয়েছেন, যা শতকরা ২৫ শতাংশ। পার্বত্য চট্রগামের প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ছে বেকারত্ব ও অভাব। সমতল আদিবাসীদের একটা বড় অংশ না খেয়ে বা একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
মূলত মাঠ পর্যায় থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আপৎকালীন সমস্যাগুলো তুলে এনে সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরাই আজকের এই আলোচনার লক্ষ্য। এছাড়া করোনাকালে দেয় সরকারের প্রণোদনা সহায়তা যেন অধিকতর কার্যকরভাবে বিতরণ করা সম্ভব হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যেন বিশেষভাবে সহায়তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখেই এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম এ মান্নান। এছাড়া বিশেষ হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, সিপিডি’র ডিসটিংগুইসড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ডিএফআইডি’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি জুডিথ হারবার্টসন, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনাগুহ ঠাকুরতা ও নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন। এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
আলোচনা অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন সামাজিক নিরাপত্তা বলয়কে আরো অনেক ব্যাপক করে ভাবতে হবে। আমরা বেসরকারি সংস্থাদের সাথে নিয়ে কাজ করতে চাই। মন্ত্রী বলেন সরকারকে কেন আহ্বান জানাতে হবে। সবাই এগিয়ে এলে সরকার সবার সাথে কাজ করবে। উনি আলোচনায় যেসব সমস্যার কথা আলোচিত হয়েছে, সেগুলোর উত্তর দেন। সঞ্চালক শাহীন আনাম বলেন সরকার অনেক কিছুই করছে কিন্ত বন্টনটা সুষ্ঠু করতে হবে। উনি বলেন আমাদের এখন এমন করে কাজ করতে হবে যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন প্রচলিত দরিদ্র যারা আছেন তারা ছাড়াও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অনেকেই নতুন করে বিপদে পড়েছেন। এই ২ থেকে ৩ কোটি মানুষ নতুনভাবে বিপদে পড়েছেন। ডিএফআইডি’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি জুডিথ হারবার্টসন বলেছেন, দেশের অনেকেই এখনো সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে আছেন। করোনার কারণে পুরো বিশ্বেই সমস্যা চলছে। তবে বৃটিশ সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে।
এমজেএফ আয়োজিত অনলাইন বৈঠকে প্রান্তিক মানুষের জীবনের এই দু:খ-দুর্দশার তথ্যগুলো উঠে এসেছে। করোনাকালে দেয় প্রণোদনা সহায়তার অংশ হিসেবে সরকার দরিদ্র মানুষের খাবার (ভিজিএফ) এবং দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচির আওতায় খোলা বাজারে কম দামে চাল বিক্রি এবং সামাজিক সেফটি নেট কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া সরকার করোনাকালে ৫০ লাখ দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ১,২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে আর এই বিতরণ কাজ চালানোর জন্য ৮ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দও ধরা হয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ের ৭ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ১৬ লাখ মানুষ এই টাকা পেয়েছেন। বাকি ৩৪ লাখ মানুষ এখনো সেই সহায়তা পান নাই।
এমজেএফের প্রকল্প এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষ্য অনুযায়ী সরকারের ত্রাণ তাদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছেনি। কারণ স্থানীয় সরকারের দ্বারা করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপকারভোগী তালিকায় অনেক গড়মিল রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ( টিআইবি) এর একটি জরিপে উল্লেখ করা হযেছে যে শতকরা ৮২ ভাগ এলাকায় ত্রাণ দেয়ার জন্য উপকারভোগীদের তালিকা তৈরির সময়ে রাজনৈতিক পরিচয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
এমনকী যথাযথ তথ্য উপাত্তের অভাবে বলাও যাচ্ছেনা যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঠিক কতজন মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অণে¦ষণ জানিয়েছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব বেড়েছে শতকরা ৩ ভাগ।
বিভিন্ন জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে গেছে যে এই মহামারি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাকুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং খাদ্যপ্রাপ্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্র্যাক ও পিপিআরসি জানিয়েছে যে গ্রাম ও শহরের বস্তির ৫৪৬১ টি বাড়িতে জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছে যে এই পরিবারগুলোর আয় শতকরা ৭০ ভাগ এবং খাবারের খরচ শতকরা ২৬ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী করোনার জন্য নির্ধারিত সাহায্যের অনেকটাই বন্যা উপদ্রুত এলাকায় চলে গেছে। এমজেএফের সহযোগী সংগঠনগুলো উত্তরাঞ্চলের বন্যা আক্রান্ত প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য সাহায্যেও আবেদন জানাচ্ছে। সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন আক্রান্ত এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষ। কারণ তারা ত্রাণের জন্য কোথাও যেতে পারছেন না। তাদের একার পক্ষে আশ্রয়ের জন্যও যাওয়াও প্রায় অসম্ভব।
আলোচনাকালে মেঘনাগুহ ঠাকুরতা বলেন, সামনে ৮ম পরিকল্পনা প্রণীত হতে যাচ্ছে। সেখানে যেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতে ঝুঁকি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে মহামারির ইস্যুটাকে অন্তর্ভুক্ত করে এটা রিভাইজ করা হয়। রাজা দেবাশীষ রায় বলেন আদিবাসীদের জন্য যে ত্রাণ তা খুবই অপ্রতুল। অনেকেই এখন একবার দিনে খাবার খাচ্ছেন। কাগজে কলমে যে সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে পাচ্ছেনা।
নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন বলেন সরকারের সব মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদা করে কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু এক ছাতির নীচে আনা হচ্ছেনা কেন। শারমিন মুর্শেদ বলেন সমতল আদিবাসীদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সরকার কীভাবে তাদের সাথে থাকবেন। হিজড়াদের জন্য মাসোহারা বাড়ানো হোক। এরোমা দত্ত এমপি বলেন, আমাদের একটা একশন প্ল্যান করতে হবে সবাইকে সাথে নিয়ে। পরিকল্পনা হবে জরুরি, মধ্যম জরুরি এবং দীর্ঘ মেয়াদি। কে কিভাবে সাহায্য পাচ্ছে, তা দেখা দরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কিভাবে ভাগ করবো, এটা দেখতে হবে। সবার জন্য এক পদ্ধতি দিলে হবেনা।
হিজড়া, জেলে, আদিবাসী, হরিজন ও প্রতিবন্ধীদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা জানান যে তাদের কেউ কেউ এককালীন সাহায্য পেলেও অধিকাংশ কেউ কোন সরকারি সহায়তা পান নাই করোনাকালে। হরিজনদের পক্ষ থেকে বলা হয় পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা দিনরাত করেছেন কিন্তু তারা কোনরকম পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস কিচ্ছু পায়নি। দলীয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রণোদনা ভাতা ও মারা যাওয়ার পর সুযোগ সুবিধা পাবেন বলে বলেছেন, কিন্তু পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথা বলেননি। ভাতাও পেয়েছে তারা খুব কম মানুষ। অধিকাংশ মানুষ ঘুপচি ঘরে থাকে। তাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই বসবাসের জন্য। জেলেরা কিছু সহায়তা পাননি বলেছেন শুধুমাত্র সুষ্ঠু বন্টনের জন্য। তারা আবার জেলে আইডি কার্ড দেয়ার দাবি জানান। প্রতিবন্ধীরা বলেছেন তারা যখন করোনাকালে সাহায্য চাইতে গিয়েছেন তখন অনেককেই শুনতে হয়েছে প্রতিবন্ধীরা এমনই ভাতা পায়।
Leave a Reply