কভিড-১৯ বর্তমান বিশ্বের জন্য প্রলয়ঙ্করী মহামারি, যা বিশ্ববাসী লাখ লাখ মানুষকে কর্মসংস্থান ও জীবিকা উপার্জন থেকে দূরে সরিয়ে ভয়াবহতা সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরকম কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন আর হতে হয়নি। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও ইইউর বলয়ভুক্ত ধনী দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, বেকারত্ব এবং মানুষের জীবনধারণ ও অন্যান্য বড় ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য কোটি কোটি ডলার বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। কভিড-১৯-এর প্রভাব ঠেকানোর জন্য বিদ্যালয়, বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট বন্ধ রাখার কারণে জনজীবনে, বিশেষ করে নিম্নআয়ের (শ্রমিক শ্রেণির) মানুষের জীবনধারণের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে। তাদের উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কয়েক হাজার জনগোষ্ঠী নিজ কর্মএলাকা ত্যাগ করছেন। পোশাক শিল্পে কর্মআদেশ বাতিলের অনিশ্চয়তার কারণে এতে নিযুক্ত প্রায় ৫ মিলিয়ন শ্রমিক (যার বেশিরভাগই নারী) বর্তমানে কর্ম হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। যদিও বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা, যেমন- খাদ্য বিতরণের মতো বিশাল ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে।
তবে বিশেষভাবে বলা চলে এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক-কর্মীরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। যার কারণে তাদের প্রতিও আমাদের বিশেষ দৃষ্টিপাত করা দরকার। ২০০৬ সালের শ্রম আইন, যা পরবর্তীকালে ২০১০, ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে এর বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালায় শ্রমিক নিয়োগকারীর সম্পর্ক এবং সুবিধাদি নিয়ে বিস্তারিত বলা রয়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক-কর্মী সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তাদের মূলত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন-২০০৬-এ অনানুষ্ঠানিক খাতকে সে ধরনের ‘বেসরকারি সংস্থা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের শর্তাদি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বিদ্যমান শ্রম আইন, বিধি বা নীতিমালার অধীনে প্রবর্তিত বিধান দ্বারা নির্ধারিত ও পরিচালিত হয় না এবং যেখানে শ্রমিকদের সংগঠিত করার সুযোগ খুবই সীমিত।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশেষ করে ‘লকডাউন’ অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৬৪ মিলিয়ন মানুষ, যা মোট জাতীয় কর্মসংস্থানের ৫১.৪ শতাংশ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। মূলত তারা হলেন রিকশাচালক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার, ভাঙাড়ি সংগ্রহকারী, পরিবহন শ্রমিক, খণ্ডকালীন গৃহকর্মী ইত্যাদি (উৎস :বিবিএস)। দেশে ৫-১৪ বছর বয়সী প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন বা ১২.৬ শতাংশ শিশু এসব খাতে শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় রিকশাচালকদের কোনো যাত্রী নেই, নির্মাণ কাজও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিনমজুররাও অলস দিন কাটাচ্ছেন। আত্মকর্মসংস্থানকারী ও হকার, খাদ্য বিক্রেতা, দৈনন্দিন জিনিসপত্র বিক্রয়কারীরা, নারী-পুরুষ উভয়ই যারা এসব পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের কোনো ক্রেতা নেই। এ সমস্যা ব্যাপক ও ভয়াবহরূপে প্রতীয়মান। যেখানে সচ্ছল মানুষজন হয় বাসা থেকে কাজ করছেন এবং বই পড়ে, ব্যায়াম করে অথবা ধ্যান করে সময় পার করছেন, সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার।
আমরা এ বিষয়ে অবগত যে- যুদ্ধ, সামাজিক অস্থিরতা বা বর্তমানের মতো মহামারিসহ যে কোনো ধরনের সংকটময় পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত নারীরা শুধু তাদের পরিবারকে সহায়তা প্রদান করার জন্য যে জীবিকা অর্জন করেন তা নয়, এর পাশাপাশি তাদের সন্তানদেরও দেখাশোনা করতে হয়। জীবিকা নির্বাহের প্রতিটি মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেলে তাদের জন্য বিকল্প কিছু নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে নারীপ্রধান পরিবারগুলো। পথশিশু ও কর্মজীবী শিশু, ছেলে ও মেয়ে উভয়ই যারা কিনা সামান্য সামাজিক সহায়তা পেত তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। আশ্রয়কেন্দ্র, ড্রপ-ইন-সেন্টার এবং অন্যান্য সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের স্বল্প উপার্জনও এখন নেই। তাদের এখন পরিবারে ফিরে যেতে হবে, সেখানে তাদের সহায়তা করার কেউ নেই। কিশোর-কিশোরীরা এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, কারণ তারা দুস্কৃতকারীদের শিকার হতে পারে।
উল্লেখ্য, আমাদের সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়; তবে কত লোকের কাছে তা পৌঁছাবে, সে বিষয়টি সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েই যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যৌনকর্মী, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এবং বিশেষ করে শিশুসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কী হবে, সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের লক্ষিত জনগোষ্ঠী নির্ধারণের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জানি। এ পরিস্থিতিতে প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করতে কৌশল চিহ্নিতকরণ ও সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে এটি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, বেঁচে থাকার জন্য শুধু চাল, ডাল ও রান্না করার তেলের চেয়েও আরও বেশি কিছু দরকার। অসুস্থতা, দুর্ঘটনা ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ভবিষ্যতে তাদের নগদ অর্থেরও প্রয়োজন রয়েছে।
আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও বেতন দেওয়া প্রয়োজন। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন জরুরি পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দুই মাসের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে। সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তিন মাসের জন্য রেশন কার্ড চালু করতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এনজিও সেক্টরের সঙ্গে সমন্বয় করে সহযোগিতা, ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে এনজিওগুলো সরকারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে।
সমাজকল্যাণ বিভাগকে বিশেষভাবে কর্মজীবী ও পথশিশুদের দায়িত্ব নিতে হবে। লক্ষাধিক এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যগত বিষয় বিবেচনা করে জরুরি ভিত্তিতে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা যদি একদিনের জন্য কাজ বন্ধ করে দেয়, তবে এর প্রভাব কী হবে- তা ভেবে দেখতে হবে। তাই সংকটময় এ পরিস্থিতিতে তারা আমাদের বিশেষ মনোযোগের দারি রাখে।
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
Leave a Reply