ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি, ২০২১: দেশে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়েরকৃত ২৫ টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টা পর হতে ১৫ দিনের মধ্যেই অভিযুক্ত ২৫ জন আসামী জামিন পেয়েছে। বর্তমানে ২০ জন অভিযুক্ত ধর্ষক জামিনে মুক্ত অবস্থায় রয়েছে, ৩ অভিযুক্ত ধর্ষক কারাগারে রয়েছে এবং ২ জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকী তাদের গ্রেফতারও করা হয়নি। উপরন্তু অধিকাংশ আসামী জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
এই ২৫ টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে অধিকাংশই বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে রয়েছে। মামলা দায়েরের পর থেকে ৬ মাসের মধ্যে চার্জশীট হয়েছে ২২ টি মামলায়। তবে ২০১৪ -২০১৫ সালে চার্জশীট হয়েছে এরকম ৯ টি মামলার রায় এখনো হয়নি। ২০১৬-২০১৭ সালে চার্জশীট হয়েছে এরকম ১২ টি মামলার রায় এখনো হয়নি এবং দুটি ক্ষেত্রেই কোন তেমন কোন অগ্রগতিও হয়নি। ৩ টি মামলাতে এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দাখিলই করা হয়নি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ( এমজেএফ) আজ এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই তথ্য তুলে ধরেছে। এমজেএফের ৭ টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ফলোআপকৃত ২৫ টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা এবং ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণগুলো খুঁজে বের করাই এই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। কারণ বারবার প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে যে অব্যাহত প্রতিবাদ এবং মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকার পরেও কেন ধর্ষণের হার বাড়ছে? মানুষ জানতে চাইছে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, নানাধরণের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সদিচ্ছার অভাব কি এইজন্য দায়ী?
দেশের ১০ টি জেলা – ঢাকা, গাজীপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর এবং জয়পুরহাট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলার আইনগত দিক উপস্থাপনা করেছেন সিনিয়র আইনজীবি এলিনা খান।
এই ২৫ টি মামলার মধ্যে ২টি মামলা একদম নিস্ক্রিয় অবস্থায় আছে। ৪ টি মামলার নথি পাওয়াই যাচ্ছে না। যে ২০ টির চার্জশীট হয়েছে, সেগুলোর ৬ – ২৩ বার শুনানি হয়েছে। ০১ টি মামলার এখনো মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট হয়নি। দেখা গেছে বেশির ভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে এইসব মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে নারাজ।
কেন ধর্ষণ মামলার বিচারের দেরি হচ্ছে এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে মামলা বিচার এর জন্য নথি প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করা এবং মামলার শুনানি শুরু হলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, প্রতি কর্মদিবসে একটানা পরিচালনার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা যথাযথ ভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়সীমা তথা ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হচ্ছে না। এছাড়া পাবলিক প্রসিকিউটর ভিকটিম ও সাক্ষীকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির করানোর ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহন করেন না। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষনের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। আসামী পক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষনের শিকার শিশু ও নারীর প্রতি ইচ্ছাকৃত খারাপ আচরণ করেন। এমনকি আইনে ধর্ষনের অপরাধ আপোষ অযোগ্য হলেও, পারিপার্শ্বিক চাপে আপোষ রফার ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় নির্লিপ্ত থাকেন। মেডিকো লিগ্যাল ও সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে টু-ফিঙ্গার টেষ্ট এর মতো অবমাননাকর পদ্ধতি উচ্চ আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে।
এই ধর্ষণের শিকার ২৫ জন নারী ও শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী ৩ জন । ৫ থেকে ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু ৪ জন, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু ৫ জন এবং ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী কিশোরী ও নারী ১৬ জন। ২টি ধর্ষণের ঘটনায় ২জন প্রতিবন্ধী নারীর ২টি সন্তান হয়েছে। কিন্তু এই শিশু দুটি এখনো পিতৃত্বের পরিচয় পায়নি। ধর্ষণের ফলে জন্ম হওয়া শিশুর দ্বায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করার কথা থাকলেও সেটা কার্যকর হচ্ছে না।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এই সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বলেন, ধর্ষণ ঘটনার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা না বরং বেড়েই চলছে। তাই আমরা সব র্ধষণ মামলার দ্রুত বিচারের চাইছি। কিন্তু বিচারের বদলে বাড়ছে ধর্ষণ, ধর্ষণের আগে নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর পোশাক, চলাফেরা, কাজের ক্ষেত্র, ও পরিবারের প্রতি নানাধরণরে অভিযোগ। আমরা আরও দেখেছি ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর প্রতি দোষ দেয়ার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহতি হচ্ছে এবং এইসব অপরাধ ঘটাতে আরো অনুপ্রাণিতবোধ করছে।”
এমজেএফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে অভিযুক্ত ৫ আসামী জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে । ভিকটিম ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহাররে জন্য ভয়ভীতি প্রর্দশন করা সহ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে ৪ জন অভিযুক্ত। অপরাধী। মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য না দেয়ার জন্য ভীতি প্রর্দশন করছে ৪ জন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের প্রভাবিত করে বিভিন্ন মাধ্যমে সহিংসতার শিকার নারী ও তার পরিবারকে আপোষ রফা করতে চাপ প্রয়োগ করছে ৬ জন অভিযুক্ত।। ভিকটিমকে সহযোগিতা করার জন্য যে সমাজকর্মীরা এগিয়ে এসেছেন, তাদের হুমকি দিয়ে নিবৃত্ত করার অপচষ্টো করছে ২ জন।
উল্টোদিকে দেখা গেছে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষনের শিকার শিশু ও নারীকে অশোভন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন, ধর্ষণের ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি করে ভিকটিমকে বর্ণনা করতে বাধ্য করেন এবং নানাভাবে চরিত্র হনন করেন। অভিযুক্তকে আটক করার ক্ষেত্রে অনীহা বা ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে।
অস্বাভাবিক দেরিতে ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় বলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। মেডিকেল রিপোর্ট সঠিকভাবে লিখা হয়না। ভিকটিমের বয়সের সাথে ধর্ষণের মামলা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হলেও রিপোর্টে বয়স সঠিকভাবে লেখা হয়না। অস্বাভাবিক দেরিতে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তা ভিকটিমকে সরবরাহ করা হয়না। দেশের বেশির ভাগ জেলা সদর হাসপাতালে ভিকটিমের বয়স নির্ধারনের ব্যবস্থা নাই। অনেক ক্ষেত্রেই ডিএনএ টেষ্ট করা হয় না। আর হলেও আসামী ডিএনএ টেষ্ট এর ফলাফল প্রভাবিত করে।
যে ৭ টি সহযোগী সংগঠন এই কাজে সহায়তা করেছে, তারা হচ্ছে – নারীপক্ষ, সিআরপি, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, পল্লীশ্রী, সাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, পিপলস অরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম এবং মহিদেব যুব কল্যাণ সমিতি।
এই সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়েকটি দাবি জানানো হয়েছে। যেমন ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত ও বিচার শেষ করা ও আইনী বিধানসমূহ সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা প্রবর্তণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ধর্ষণের মামলা আপোষ করা বা আপোষের চেষ্টা করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা।
প্রয়োজনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের, ২০০০-এর ১৫ ও ১৬ ধারা সংশোধন করা। আর ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ভাষা ও শ্রবণ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য দিতে পারে, এমন ব্যবস্থা রেখে আইনটির সংশোধন করা।
মেডিকেল রিপোর্টে কোনরকম ত্রুটি শাস্তিযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা। ভিকটিমের আইনী সহায়তা নিশ্চিত করা। কেবলমাত্র আইনজীবীর সহযোগিতা না দিয়ে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু এবং সাক্ষীর আদালত সহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ও অন্যান্য ব্যয় বহন করা।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কোর্ট স্টাফ ও ধর্ষণ মামলার বিচার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, সংস্কারকৃত আইন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
শাহানা হুদা রঞ্জনা
সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
০১৭১১৮৪৬৪৮০
Leave a Reply