ঢাকা, ০৯ জানুয়ারি, ২০২১: করোনাকালে সারাদেশে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও শিশুদের জনসমাগমের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং বাল্যবিবাহ ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি সার্বিকভাবে উদ্বেগজনক বলে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
আজ সকালে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২০’ শিরোনামে শিশু অধিকার-বিষয়ক সংবাদের আধেয়-বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করে এমজেএফ বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে।এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সঞ্চালনায় আজকের সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের শিশু-অধিকার বিষয়ক ককাসের সদস্য অ্যারোমা দত্ত এম.পি। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব জনাব মুহিবুজ্জান। এমজেএফের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ফাতেমা ইউসুফসহ এমজেএফের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন আলোচলায় অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২০’র সার্বিকচিত্র উপস্থাপন করেন এমজেএফের শিশু সুরক্ষা বিভাগের সমন্বয়ক রাফেজা শাহীন।
৫টি জাতীয় বাংলা দৈনিক- প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ এবং তিনটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ষ্টার, নিউ এজ এবং ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত শিশু অধিকার বিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা অনুযায়ী এই সময়ে ৭১৬ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং বাল্যবিবাহ ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় বছরজুড়ে করোনা পরিস্থিতি সত্ত্বেও করোনাকালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২৬ জন শিশু এবং এই সময়ে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩৭ জন শিশুকে। অন্যদিকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে ১০১ শিশু।
এমজেএফের পর্যালোচনা অনুযায়ী অবনতিশীল শিশু অধিকার পরিস্থিতি থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়, কারণ অধিকাংশ শিশু-ধর্ষণ পারিবারিক পরিমণ্ডলে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। একইভাবে পারিবারিক প্রভাবের কারণেই করোনাকালে বাল্যবিবাহ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ১৯২জন শিশু নিহত হয়েছে, যার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশুর সংখ্যা ১৫৮ জন। একইসময়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৬৫ জন শিশু। এছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরো ১৪৫ জন শিশু করােনা কালীন গৃহর্কমী হিসেবে কাজ করার সময় ৭ জন মেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়, যার মধ্যে তিনজন শিশু মারা যায়।
পর্যালোচনা অনুযায়ী ২০২০ সালে ১৩ থকেে ১৮ বছর বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে বেশি। এরপর রয়েছে ৭ থকেে ১২ বছর বয়সী শিশুরা। শিশুদের চকলেট বা খাবাররে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে এবং ঘরে একা পেয়ে র্ধষণ করা হয়েছে। । এমনকি করোনাকালীর সময়ে ত্রাণ দেয়ার কথা বলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
২০২০ সালে হত্যা ও হত্যার চেষ্টা করা হয়ছেে ১৪৫ জন শিশুকে। ১৩ থকেে ১৮ বছরের শিশুরাই বেশি হত্যাকান্ডরে শিকার হয়েছে।প্রকাশিত সংবাদে হত্যার কারণ হিসেবে পারিবারিক কলহ, সম্পদ বন্টণজনিত জটিলতা, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান, মেয়ে হয়ে জন্মানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ, মানসিক চাপ এবং ধর্ষণে র্ব্যথ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আলোচ্য সময়ে আত্মহত্যা করছেে ৩৪ জন শিশু এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছে ২৩ জন। পরীক্ষায় ফল-বিপর্যয়, পরিবারের উপর রাগ, প্রেম, উত্যক্ততা, ধর্ষণের শিকার বা ধর্ষণ -চেষ্টা, ধর্ষণের বা শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়ার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সাইবার ক্রাইমের বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
২০২০ সালে নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয়েছে ২৯ জন শিশু। অপহরণের কারণ হিসেবে টাকার জন্য, প্রেমঘটিত সমস্যা, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, প্রতিশোধ গ্রহণ, পাচার ও মুক্তিপন দাবি সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে শিশি নির্যাতনেই ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনকারী হিসেবে গৃহর্কতা, বাবা-মা, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, স্থানীয় চেয়ারম্যান, চাকুরীদাতা, প্রতিবেশী, সৎ মা, সহর্কমীর নাম প্রকাশিত শব্দে উল্লেখিত হয়েছে। শিশুকে নিয়ে নেতিবাচক শব্দের তালিকায় আরো রয়েছে অপরাধে শিশুর সংশ্লিষ্টতা এবং নবজাতকের মৃত্যু। উল্লেখ্য, এমজেএফের বিশ্লেষণে ২০২০ সালে ১২ ধরণের ইতিবাচকের সংবাদের সংখ্যা ৩৩০টি, এবং ২৬ ধরনের নেতিবাচক ঘটনায় ১৩৬১টি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, এমজেএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিশুরা নিজের বাসায় নিরাপদ নয়। শিশুরক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের সকলকে আরো বেশি দায়িত্ববান হওয়ার পাশাপাশি শিশু অধিকার রক্ষায় সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহবান জানান।
অ্যারোমা দত্ত এম.পি দেশে বিরাজমান নারী-শিশু নির্যাতনকে ‘সূর্যগ্রহণের গ্রাস’র সাথে তুলনা করেন। তিনি শিশু অধিকার রক্ষার কাজ নিবিড়ভাবে সম্পাদনে শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে নীতিনির্ধারণ, কর্ম-সম্পাদন ও কাজের নিবিড় তদারকীর জন্য সবাইকে যৌথভাবে কাজ করার আহবান জানান।
মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব জনাব মুহিবুজ্জামান বলেন, শিশু নিরাপত্তার সংকট উদ্বেগজনক। তিনি আইনি কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে বিরাজমান সমস্যা মোকাবেলার পরামর্শ দেন।
ফাতেমা ইউসুফ করোনার কারণে শিশু শিক্ষার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রাফেজা শাহীন ধর্ষকের মনস্তত্ব নিয়ে অধিক মনোযোগের জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহবান জানানা।
এমজেএফের বার্ষিক ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি’ পর্যালোচনার অন্যতম উদ্দেশ্য হল শিশু সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতি নির্ধারনী সুপারিশ তুলে ধরা। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটি ২০০৯ সালে প্রণীত তাদের “বাংলাদেশ বিষয়ক সমাপনী পর্যবেক্ষণ” প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি নিরূপণের জন্য নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের একটি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। এই প্রেক্ষিতে এমজেএফ ২০১১ সাল থেকে সংবাদপত্রকে উৎস হিসেবে ধরে শিশু সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের সংবাদ নিয়মিত সংরক্ষণ করতে শুরু করে। এমজেএফ ঝুঁকিপূর্ন শিশুশ্রম নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করলেও শিশু নির্যাতন, শিশুর সাফল্য, হত্যা, আত্মহত্যা, যৌন নিপীড়নসহ শিশুর অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন উপাদান তার কর্ম পরিধির মধ্যে রয়েছে।
Leave a Reply