ঢাকা, ২৪ এপ্রিল, ২০২১: ২০২০ এর করোনাকালে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ৪৮.৪৯ শতাংশ পরিবার থেকে অন্তত একজন কাজ হারিয়েছেন বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন শহরের ৭৩.৩ ভাগ মানুষ এবং গ্রামের ৯২.৫ ভাগ মানুষ।
”বাংলাদেশে ২০২০-এ করোনা চলাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রæত বিশ্লেষণ” শীর্ষক এক জরিপ উপস্থাপণকালে আজ এই তথ্যগুলো উঠে এসেছে। এইসময়ে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, দারিদ্রের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাব, ইত্যাদি তুলে ধরার লক্ষ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৭৬ জন বলেছেন যে মহামারির সময়ে তাদের পরিবারের আয় কমে গেছে। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয়কারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬৮ জনের আয় কমেছে। এরমানে হচ্ছে এই মানুষগুলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়কারীদের শতকরা ৭৩ জনের আয়ও হ্রাস পেয়েছে। দেখা গেছে কৃষিনির্ভরগুলো পরিবারগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো থাকলেও, যারা অকৃষি কাজের সাথে জড়িত অর্থাৎ শ্রমজীবি মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ।
শতকরা ৭৭.৭৮ টি নারী প্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অনানুষ্ঠনিক খাতের। নারীদের অনেকেই কাজ বা চাকরি হারিয়েছেন। পাশাপাশি বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘরের কাজের চাপ। কেন করোনাকালীন সময়ে সেবা কাজের আলোচনায় সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে টেনে আনা হলো, এ প্রশ্নের নানাবিধ জবাব হতে পারে। বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে শতকরা ৯১.৩ জন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এদের শতকরা ৯৬.৭ জন নারী।
যখন অভাবের কারণে একটার পর একটা সম্পদ হাতছাড়া হতে থাকে, তখন এর মধ্যে জেন্ডার ব্যয় এর ইস্যুটা লুকিয়ে থাকে। কারণ অভাব অনটনের সময় নারীর সম্পত্তিই প্রথমে হাতছাড়া হয়। অর্থনৈতিক সংকট হলে প্রথমে পাড়া প্রতিবেশীর থেকে ধার করে মানুষ। এরপর ছোটখাট জিনিস যেমন স্বর্ণালংকার ও ছোট পশুপ্রাণী বন্ধক রাখা হয়, যেগুলোর মালিক সাধারণত নারীই হয়ে থাকে। এরপর আসে বাড়ি, জমি বা গরু বিক্রি। অভাবের সময় যৌক্তিক কারণেই নারীর মালিকানাধীন ছোটখাট জিনিষ আগে বিক্রি করা হয়। সেক্ষেত্রে সবদিক থেকেই নারীই সর্বস্বান্ত হয় প্রথমে।
রান্নাকরা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ধোয়ার কাজ গ্রামীণ নারীর মতো হলেও আশ্চর্যজনকভাবে শহরে নারীর কাজ ১২৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে এই মহামারির সময়ে। শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মজীবি নারী অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন এবং সেটা ৪ ঘন্টারও বেশি সময়। শহরের নারী উত্তরদাতাদের কাছে গৃহস্থালি কাজের মধ্যে প্রথমদিকে আছে স্বামীর যতœআত্তি করা। এরপর আছে সন্তান ও পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা করা।
করোনার আগে গৃহিনীদের মধ্যে শতকরা ৭১.৫ জন সাধারণত ৩ থেকে ৫ ঘন্টা সময় অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করতেন। করোনাকালে এসে এদের মধ্যে শতকরা ৩৭.৮ জনের কাজের সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এইসময়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে। নারীর ঘরে কাজের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে কোন কোন ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ ঘন্টার কাজ ৬/৭ বা ৮ ঘন্টার কাজের তালিকায় পৌঁছে গেছে।
৫-সদস্য বিশিষ্ট ফোরাম ”ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্যা উম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক” এর উদ্যোগে এই জরিপটি পরিচালনা ও তৈরি করেছেন শারমিন্দ নিলোর্মী, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই ফোরামের সদস্য সংস্থাগুলো হচ্ছে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, অক্সফাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য। বিশেষ অতিথি ছিলেন সোকো ইশিকাওয়া, ইউ এন উম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ। জরিপের উপর আলোচনা করেছেন ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি এবং মেহেদী মাসুদুজ্জামান, ডেপুটি সেক্রেটারি, ফিন্যান্স ডিভিশন। আরো বক্তব্য রেখেছেন বিএনপিএস এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ কবীর এবং সার হল, উম্যান এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড কেয়ার প্রোগ্রামের ম্যানেজার, অক্সফাম, গ্রেট ব্রিটেন। সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
২০২০ সালে করোনা চলাকালে নভেম্বর মাসে জরিপের কাজ শুরু হয়েছিল, চলেছে জানুয়ারি পর্যন্ত। দেশের নয়টা জেলায় শহরের ও গ্রামের বিভিন্ন পেশা ও বয়সের মধ্যে জরিপটি চালানো হলেও জরিপের প্রেক্ষিতের কথা ভেবে নারী উত্তরদাতার সংখ্যা বেশি ধরা হয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জন নারী, শতকরা ১৩ জন পুরুষ ও শতকরা ১ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এদের মধ্যে ২১৯ জন গ্রামের এবং ২২৪ জন শহরের এবং শতকরা ৫৮ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ গৃহিনী। বাকিরা অন্যান্য পেশাজীবি।
করোনাকালে সন্তান যখন অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিয়েছে তখন শহরের শতকরা ৩৪.৪ জন মা তাদের সন্তানকে সহযোগিতা করেছেন, গ্রামে শতকরা ৭.৩ জন বাবা তাদের সন্তানদের টিভির মাধ্যমে পড়াশোনা করতে সাহায্য করেছেন।
শহরের প্রায় ২৮ শতাংশ নারী বলেছেন শিশুদের পড়াশোনার সাথে তাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে গ্রামের শিশু ও পিতামাতা কারোর জন্যই পড়াশোনা নিয়ে করোনাকালে কোন কার্যক্রম নেই। অথচ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৪ এর পুরোটাই শিক্ষা সংক্রান্ত। মেয়েশিশুর পড়াশোনা বন্ধ মানে বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি এবং গৃহে ও সমাজে নারীর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
উত্তরদাতাদের শতকরা ৮২.৭৮ জন মনেকরেন মহামারি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছে। করোনাকালের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে মানসিক চাপ এবং শারীরিকভাবে মানুষকে দুর্বল করে তুলেছে। গ্রামীণ নারী উত্তরদাতাদের মধ্যে অর্ধেকই নিজেদের মানসিকভাবে দুর্বল মনে করছেন। বাকিদের মধ্যে শতকরা ২০ জন নিজেদের মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ভাবছেন। শহরের শতকরা ২৩ জন নারী নিজেকে মানসিকভাবে খুবই দুর্বল বলে মনেকরছেন।
সব পুরুষ উত্তরদাতা এবং গ্রামের শতকরা ৯৭ জন ও শহরের শতকরা ৮৮ জন নারী নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। করোনাকালে ঘুম কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে বা কমে যাওয়া, শরীর ও মাথা ব্যথা বড়ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা। এরমধ্যে মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে গ্রামে ও শহরে।
জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে যে সবধরণের সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা শতকরা ৫৪.২৫ জন গ্রামের মানুষ পেয়েছেন শহরে এই সংখ্যা ২২.৯৭।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন যে আমাদের দেখতে হবে এই অনানুষ্ঠানিক কাজকে আমরা কিভাবে জাতীয় ডেটা বেইজে সন্নিবেশিত করতে পারি। আমরা নারীর এই শ্রমকে আসছে অর্থবছরের এসএনএ তে যোগ করতে চাই্। নারী যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় কাজ করছে, সেটারও একটা মনিটরিং ভ্যালু বের করতে হবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সোকো ইশিকাওয়া বলেন ইউএন উম্যান সবসময় এই কাজের সাথে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে আমাদের ভাবতে হবে নারীর এই কাজকে আমরা কিভাবে দৃশ্যমান করবো।
সভাপ্রধানের বক্তব্যে শাহীন আনাম বলেন যে নারীর কাজকে দায়িত্ব মনে না করে যেদিন কাজ বলে মনেকরতে শিখবো সেদিনই নারীর কাজের মূল্য যোগ হবে।
শাহানা হুদা রঞ্জনা
সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
০১৭১১৮৪৬৪৮০
Leave a Reply